Thursday, June 29, 2023

দেবদাসী: ধর্মের মোড়কে গণিকাবৃত্তি ।। ভূমিকা ।। রচনা: রবি রায় ।। পৃষ্ঠা ১


শুরুর কথা

“If one copies from one source, it is plagiarism; if one copies from many sources, it is research.” – এরূপ বিচারে আমার এই ক্ষুদ্র রচনাটিকে একটি গবেষণাধর্মী রচনা বলা যেতেই পারে। তার সাথে এই কথাও বলা যায়, এই কাজে বর্তমান নিবন্ধকের কৃতিত্ব কেবলমাত্র যথাযথ তথ্য সংগ্রহকারীর, যাঁদের রচনা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, মূল কৃতিত্ব প্রাপ্য তাঁদেরই। তবে নিজের সপক্ষে এটুকু বলা অত্যুক্তি হবেনা যে নকলনবিশীর সময় নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তথ্য বাছাই-এ সম্ভবত ভুল হয়নি। আর বহু প্রাচীন দেবদাসীপ্রথা যে আসলে ধর্মের মোড়কে গণিকাবৃত্তি, সাধারণ পাঠকের সামনে এই সত্য উন্মোচনই হল সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্য। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে ধর্ম-সভ্যতা নির্বিশেষে আজও যারা দেবদাসী নামে পরিচিত, তাদের সাথে মন্দিরের সম্পর্ক কতটা, ঐশ্বরিক ঐশ্বর্যেই বা কতটুকু সমৃদ্ধ তাদের জীবন- এই ছিল আমার একদা অন্বেষণ। আর এই অন্বেষণ করতে গিয়ে যে সত্য প্রত্যক্ষ করেছি তা বড়ই করুণ, বড়ই নির্মম। 


দেবতার দাসী, তাই দেবদাসী। মন্দিরের দেবতার সেবায় তাদের নিযুক্তি। দেবতা তো এক প্রস্তর বা কাষ্ঠখন্ড যার সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বিশ্বাস, আর বিশ্বাস মানেই তো যুক্তিহীন। আদতে রাজা, ভূস্বামী প্রভৃতি মানবদেহরূপী দেবতাদের মনোরঞ্জন তথা শরীরি ক্ষুধা নিবৃত্তির তাগিদেই যুগ যুগ ধরে সুকৌশলে টিকিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে এই প্রথাকে। দেবদাসীপ্রথার উদ্ভব কখন, কেন, কিভাবে- এ নিয়ে গবেষণা এখনও শেষ হয়ে যায়নি, তবে নির্দ্বিধায় একথা বলা যায়, ধর্ম নির্বিশেষে নানা দেশে মন্দিরে মন্দিরে নানা নামে নানা আচ্ছাদনে যেখানে দেবদাসী নিয়োগ হত সেগুলিই পৃথিবীর প্রথম গণিকালয় (Brothel)।

দেবদাসীপ্রথা আজ অবলুপ্তপ্রায়। যেকটি স্থানে এই অমানবিক প্রথাটি আজও বিদ্যমান তার মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ ভারতের দু’টি রাজ্য - অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্নাটক। কন্যাশিশুদের দেবদাসী বানিয়ে এই রাজ্যগুলির নানা অঞ্চলে আজও অবাধে চলছে ধর্মের মোড়কে গণিকাবৃত্তি। ঐসব এলাকার বহু গ্রাম আজ মুম্বাইয়ের কুখ্যাত রেডলাইট এলাকা কামাথিপুরা-র মেয়েবাজারে পণ্যের যোগানদার হিসেবে পরিচিত। এই পণ্য মন্দিরে উৎসর্গিত নিষ্পাপ কন্যাশিশু তথা দেবদাসী। উড়িষ্যায় বিখ্যাত পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরে একদা রমরমিয়ে চলা এই প্রথা আজ অবলুপ্ত। শেষ দেবদাসীটিও প্রয়াত।


১৯৯৮ সালে, নারী ও শিশুপাচার নিয়ে কর্মরত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মুখপত্রে আমার দেবদাসী বিষয়ক এই লেখাটি প্রচ্ছদ নিবন্ধ হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে এটির ইংরেজী ভাষান্তরও প্রকাশিত হয় যা আরও তথ্যবহুল আকার নেয়। 

এই লেখাটি যখন প্রথম লিখেছিলাম তখনও বিষয়টির গভীরতা সম্পর্কে আমার সম্যক ধারণা ছিলনা।পরবর্তীকালে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেছি আমাদের দেশে এমন অনেক সম্প্রদায় আছে যাদের মধ্যে ঐতিহ্যগত ভাবেই পরিবারের প্রথম কন্যাসন্তানটিকে গণিকাবৃত্তিতে নিযুক্তি একটি সামাজিক প্রথা হিসেবে স্বীকৃত। দেবদাসীপ্রথাকেও এই গোত্রেরই (Traditional Prostitution) অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, অতিরিক্ত যেটুকু তা হল এক্ষেত্রে ধর্মের stamp সেঁটে দেওয়া হয়েছে। ১৯৯৯ সালে একটি তথ্যানুসন্ধান দলের সদস্য হিসেবে আগ্রায় থাকাকালীন এমনই একটি সম্প্রদায়ের দেখা পাই যাদের একদা শিল্পি হিসেবে খ্যাতি ছিল। বেড়িয়া (?) নামের তাজমহল স্মৃতিসৌধ-এর নিকটবর্তী বাস এই সম্প্রদায়টির পরিচিতি শহরের গণিকালয় গুলিতে নিজ পরিবারের সুন্দরী কন্যাদের যোগানদার হিসেবে। কলকাতার সোনাগাছি-তে এরাই আগ্রাওয়ালী নামে সুপরিচিত। আগ্রায় থাকাকালীন আমরা এমন একটি পরিবারে গিয়েছিলাম যে পরিবারের মেয়েরা প্রথা মেনে নিজেদের বাড়িতেই গণিকাবৃত্তি করে। বাড়ির পুরুষ সদস্যরা তাদের জন্য খদ্দের জোগাড় করে আনে। পরিবারটির সাথে কথা বলে সামান্য অস্বাভাবিকতাও অনুভব করিনি। আমাদের ভাড়া করা গাড়ির বয়স্ক চালক জানিয়েছিলেন এমন পরিবার এখানে অলিগলি তে ছড়িয়ে আছে। এই সম্প্রদায়টির নাম আজ আর মনে করতে পারিনা।


আমাদের ‘মহান’ দেশ ভারত ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দেবদাসী প্রথার উল্লেখ আছে আমার বর্তমান নিবন্ধটিতে। তবে যে সময় এটি লেখা হয়েছিল সেসময় যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ হাতে না থাকায় প্রতিবেশী দেশ নেপাল-এর কথা বাদ পড়েছিল। এই ঘাটতি কিছুটা ভূমিকাতেই পুরণের চেষ্টা করছি।

নেপালে প্রচলিত দেবকী প্রথা ভারতের দেবদাসী প্রথারই নামান্তর। নেপালের প্রত্যন্ত এলাকায় এই প্রথার অস্তিত্ব বর্তমান বলে জানা গিয়েছে গবেষক মিনা পাওয়েল-এর একটি লেখা থেকে। 

কিভাবে ও কবে থেকে এই প্রথার শুরু তার অবশ্য প্রামাণ্য কোন দলিল নেই। তবে চলে আসছে একটি কাহিনী। একদা পশ্চিম নেপাল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাসকদের শাসনাধীন ছিল। এরা আবার ‘বাইশি’ ও ‘চৌবিশি’ অর্থাৎ (বাইশটি ও চব্বিশটি) নামে দু’টি জোটে বিভক্ত ছিল। ১৭৭০ সালে সম্মিলিত নেপাল রাষ্ট্র গঠনের আগে পর্যন্ত এরকম শাসনব্যস্থাই কায়েম ছিল নেপালে। কথিত আছে একদা কোন একজন শাসকের প্রতি দেবতা (কোন দেবতা উল্লেখ নেই) রুষ্ট হন, ফলে তাঁর শাসনাধীন এলাকায় দুর্ভিক্ষ ও নানা রোগের প্রকোপ দখা দেয়। দবতার রোষ থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে সেই শাসক নিজের মেয়েকে দেবতার মন্দিরে উৎসর্গ করেন। এরপর থেকে কেউ কোন বিপদে পড়লেই নিজের মেয়েকে মন্দিরে উৎসর্গ করার প্রথা চালু হয়ে যায়। 

প্রচলিত বিশ্বাস হল- কোন মেয়ে ঋতুমতী হবার আগেই দেবতার সেবায় তাকে দান করলে দেবতা খুশী হয়। তাই দেখা যায় ৭-১০ বছরের মেয়েদেরই দেবকী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। যেহেতু দেবতার রোষ থেকে মুক্তির দাত্রী হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা হয়, তাই তাকে দেবী বলা হত। এই ‘দেবী’ শব্দটিই রূপান্তরিত হয়ে ‘দেবকী’ হয়।

দেবকীপ্রথা টিকে থাকার পিছনে রয়েছে মানুষের ভ্রান্তবিশ্বাস। অনেকে রোগভোগ বা সন্তানহীনতা থেকে বাঁচতে দেবকী করে। সাধারণতঃ নিজের মেয়েকেই দেবকী করা হয়। কিন্তু যাদের মেয়ে নেই তারা অন্যের মেয়ে দত্তক নেয়। এজন্য মেয়ের পরিবারকেও অর্থ প্রদান করা হয়। ধনীরা গরিব পরিবারের মেয়ে কিনে নিয়ে প্রথম নিজের ময়ে হিসেবে লালনপালন করে, তারপর দেবতাকে উৎসর্গ করে। বাস্তবে সম্পত্তিবানরা গরিবদের মেয়ে কিনে নিয়ে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করে। দারিদ্র্যের কারণে শিশুকন্যারা বিক্রি হতে বাধ্য হয়। যদি কখনও কোন গরিব পিতা তার মেয়েকে প্রভাবশালী ভূস্বামীদের কাছে বেচতে রাজী না হয়, তাহলে তাকে খুবই বিপদে পড়তে হয়। জমিতে কাজ করতে দেওয়া হয়না, এমনকী পুলিশের সাথে যোগসাজসে কোন-না-কোন অজুহাতে তাকে জেলেও ভরে দেওয়া হয়। এমনভাবে কেনাবেচা হয় যে মেয়েটি জানতেও পারেনা সে বিক্রি হয়েছে। কেউই এইসব মেয়েদেরকে বলেনা তাদের পরিণতির কথা। 

সাধারণতঃ উৎসর্গের পরেও তাদের পরিবারের সাথে তারা থাকতে পারে। একটু বড় হলে তারা বুঝতে শেখে তাদের পরিণতির কথা, বোঝে তারা বিক্রি হয়ে গেছে, দেবতার কাছে তাদের উৎসর্গ করা হয়েছে। একবার উৎসর্গ হয়ে গেলে এই মেয়েরা আর বিয়ে করতে পারেনা। লোকে মনে করে যদি কেউ কোন দেবকীকে বিয়ে করে তবে তার ভয়াবহ মৃত্যু হবে। শুধু তাই নয়, তাকে একঘরেও করে রাখা হয় নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যেই। এভাবেই সামাজিক বিধিনষেধ প্রয়োগ করে তাকে বিবাহিত জীবনযাপন থেকে বিরত রাখা হয়। কিন্তু যদি কোন দেবকী কারুর সাথে যৌন জীবনযাপন করে বা কারুর রক্ষিতা হিসেবে থাকে, তাতে অবশ্য কোন বাধা নেই, বাধা নেই এমনকী গণিকাবৃত্তিতেও। অনেক সরকারি কর্মচারী যারা বদলী হয়ে ঐসব জায়গায় কাজে আসে, তারা দেবকীদের রক্ষিতা হিসেবে রেখে তাদের যৌন ক্ষুধা মেটায়, বদলি হয়ে চলে যাবার সময় তাদের ফেলে রেখে যায়।

এই দেবকীদের কোন সন্তান জন্মালে তারা মন্দিরের সম্পত্তি হয়ে যায়- ছেলেরা হয় দাস আর মেয়েরা হয় দেবকী।


এই তথ্য প্রায় দু’দশক আগের। নেপাল এই সময়ের মধ্যে অনেক রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে রাজতন্ত্রের অবসান হয়েছে, কিন্তু দেবকীপ্রথার অবসান ঘটেছে এমন তথ্য বর্তমান লেখকের জানা নেই। লেখক অবশ্যই জানার চেষ্টা করবেন এবং ভবিষ্যতে তা প্রকাশও করবেন।


পশ্চিম আফ্রিকার ‘কোশিও’দের অতীতের কথা আমার নিবন্ধে উল্লেখ আছে। তবে সাম্প্রতিক সময়কার তথ্য আমার নজরে আসে লন্ডন খেকে প্রকাশিত ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকার (সম্ভবত ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে) একটি সংবাদ থেকে। একটি রিপোর্ট উল্লেখ করে পত্রিকাটি জানিয়েছে- ঘানা, বেনিন, টোগো ও নাইজেরিয়া’য় বছর আটেকের ৩৫ হাজার মেয়েকে ডাকিনীবিদ্যায় পারদর্শী পুরোহিতদের হাতে সঁপে দেওয়া হয়েছে, যারা তাদের সাথে ক্রীতদাসীর মত ব্যবহার করে ও প্রায়শই ধর্ষণ করে। মূলত যুদ্ধে সাফল্য পাওয়ার জন্য এইসব মেয়েদের উৎসর্গ করা হয় বলে জানিয়েছে "The Forgtten Girl-Slaves of West Africa' শিরোনামের এই রিপোর্টটি।  এছাড়া রোগমুক্তির জন্য বা যদি পরিবারের কেউ কোন অনৈতিক কাজ করে ফেলে, প্রধানত পুরুষেরা, তাহলে দেবতাকে খুশী করতে পরিবারের কোন নাবালিকাকে মন্দিরে ভেট দেওয়া হয়। এ যেন অনেকটা আমাদের দেশের কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষদের কালি বা শীতলা মন্দিরে পশুবলি চড়ানোর মত। ঘানার পশ্চিমাঞ্চলে এ ধরনের ঘটনা সবথেকে বেশী ঘটে থাকে। হতভাগ্য ঐসব মেয়েরা ওখানে ‘ট্রোকোশি’ নামে পরিচিত। রিপোর্টটি নিম্নরূপ:

Fetish Slaves: A report from West Africa

---

Trokosi: The practice of Devadasi in our country is similar to that of a few countries in West Africa.

---

Tens of thousands of pre-teen girls are being kept as unpaid servants and sex slaves by West African voodoo priests to pay for the sins of their families against traditional gods and spirits. 

According to a report prepared by Paul Bravender Coyle and published a few years back by Australia’s Anti-slavery Society, up to 35,000 virgin girls as young as eight in Ghana, Benin, Togo and Nigeria have been given to fetish priests who treat them like serfs and often rape them.

“Originally offered as a human sacrifice to ensure success in war, these girls are the helpless victims of slavery in which they are known locally as fetish slaves”, said the report titled The Forgotten Girl-Slaves of West Africa. “The girls are offered as slaves in order to appease the gods and to atone for wrongs committed by their relatives, usually male relations.” 

In Ghana, the children, invariably virgins are offered at a shrine after a run of bad luck, or a series of deaths in a clan. They are expected to stay with priests from the age of about eight up to fifteen and sometimes much longer. 

Most of the girl slaves have been in Ghana’s south-western regions where the voodoo practices originating in Benin take place alongside Christianity and Islam. Many of these slaves, who are known as trokosi, have two or three children by their priest-masters. These children are denied access to education, so they are unable to fend for themselves when released from their “indenture” after between three and five years. 

Many former slaves have to remain with the priests after serving the time agreed by their families because they are cut off from any other means of survival, One 86 years old woman quoted in the report said she had been a slave her entire life. 

According to a govt. official of Ghana, the practice violates the constitutional rights of children. “But it is very difficult to stop. When people believe that they have offended their gods or their ancestor spirit, they will often turn to trokosi as a solution.” 


Source: Child Slaves, ‘appeased spirits’, 

By Sam Kiley 

The Times, London, 

Estimated publication date to the late nineties.

---


পাঠক অধ্যয়নের সময় লক্ষ্য করেবেন যে, আমার মূল রচনাটিতে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ কিম্বা অখন্ড বঙ্গ সম্পর্কে কোন উল্লেখ নেই।  কারণ প্রামাণ্য তেমন কোন তথ্য সেসময় আমার সংগ্রহে ছিলনা। রচনাটি প্রকাশের পরবর্তীকালে যেটুকু তথ্য পেয়েছি তা থেকে অনুমান দশম-একাদশ শতক নাগাদ বঙ্গদেশে দেবদাসীপ্রথার অস্তিত্ব ছিল। এসময় রচিত সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিতম’-এ মন্দিরে গণিকাদের সম্পর্কের উল্লেখ আছে শুনেছি, তবে আমার নিজের দেখা হয়নি। এছাড়া আর কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। বিশেষত স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির মত দুই বাংলার কোথাও-ই দেবদাসীপ্রথার অস্তিত্বের তথ্য পাইনি (অনুসন্ধান এখনও জারি থাকছে)। তবে আমার জানা সাম্প্রতিক অতীতের একটি ঘটনার উল্লেখ করা এক্ষেত্রে প্রয়োজন মনে করছি। এটিকে অবশ্য একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখতে হবে।


কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরেজী দৈনিক The Telegraph-এ প্রকাশিত (২১.০৮.১৯৯৫) একটি খবরের (35-year-old woman ‘weded’ to Krishna idol) সূত্র ধরে ১৯৯৮ সালের ১০ নভেম্বর আমি কৃষ্ণনগরে যাই। পত্রিকাটি এখানকার এক গ্রামে দেবদাসী হওয়ার একটি ঘটনার উল্লেখ করেছিল।বিষয়টি বিশদে জানতেই আমার সেখানে যাওয়া। ফিরে এসে ‘The Bride of Krishna Idol at Krishnagar’ শিরোনামে যে নিবন্ধটি প্রকাশ করি সেটির বাংলা অনুবাদ নিম্নরূপ:

এটা ছিল ১৯৯৮ সাল, গত শতাব্দী। ২১শে আগস্ট, ১৯৯৫-এ ইংরেজী দৈনিক ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ (The Telegraph) -এ প্রকাশিত ‘‘35-year-old woman ‘wedded’ to Krishna idol’’ (‘‘৩৫-বছর বয়সী মহিলার কৃষ্ণমূর্তির সাথে ‘বিবাহ’’) শিরোনামের একটি পুরানো প্রতিবেদন হঠাৎ আমার নজরে আসে, যখন আমি বিশ্বব্যাপী ‘ঐশ্বরিক পতিতাবৃত্তি’ নিয়ে একটি নিবন্ধ তৈরি করতে ব্যস্ত ছিলাম। কলকাতা-ভিত্তিক জনপ্রিয় ইংরেজী দৈনিকটি জানিয়েছিল যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ভাতজংলা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন আদমশুমারী কর্মী নলিনীকান্ত দত্তের মধ্যবয়সী অবিবাহিত কন্যা জ্যোৎস্না দত্ত ভগবান কৃষ্ণের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। মে ‘৯৫-এর দ্বিতীয় সপ্তাহে কৃষ্ণমূর্তির সাথে এই বিবাহবন্ধন স্থানীয় মন্দিরের ৭৫ বছর বয়সী ওড়িশা বংশোদ্ভূত পুরোহিত বামদেব মিশ্র দ্বারা প্ররোচিত হয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সংবাদ আমাকে প্রকৃত ঘটনা জানার আগ্রহে অবিলম্বে ওই গ্রামে ছুটে যেতে উৎসাহিত করে। 

আমার জ্ঞানানুসারে, দেবদাসী প্রথা একাদশ শতক নাগাদ তৎকালীন বাংলাদেশে যে বিদ্যমান ছিল তার সামান্য তথ্য পাওয়া গেছে, কিন্তু পরবর্তী শতাব্দীগুলীতে এর কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না এবং ভাতজংলার ঘটনাটি একটি বিচ্ছিন্ন নজির হিসাবে বিবেচিত হতে পারে বলেই আমার অনুমান, অন্ততঃ ভারতের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়কালে। 

পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জেলা নদীয়ার একটি ঐতিহাসিক শহর কৃষ্ণনগরের সীমান্তে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক-এর পাশে অবস্থিত ভাতজংলা হল একটি বড় গ্রাম যার জনসংখ্যা প্রায় পনের হাজার (আমার অনুসন্ধানের সময়কালে), যার মধ্যে ৮০ শতাংশই শিক্ষিত। ১০ নভেম্বর, ’৯৮, আমি সেই গ্রামে কয়েক ঘন্টা কাটিয়েছিলাম এবং জ্যোৎস্না, সেই তথাকথিত ‘দেবদাসী’ সহ কয়েকজন গ্রামবাসীর সাথে দেখা করেছিলাম। এই গ্রামেরই অধিবাসী পার্থ সিকদার। তিনি একজন স্থানীয় সিপিআই (এম) কর্মী। তিনিই আমায় ভাতজংলা গ্রাম পরিদর্শনে ও অনুসন্ধানে সাহায্য করেছিলেন। একটি বাম অধ্যুষিত গ্রামে একজন মহিলাকে এক নির্বাক মূর্তির বধূতে পরিণত করার ঘটনার গুরুত্ব সম্পর্কে তার অজ্ঞতা তিনি আমার সাথে আলোচনার সময় স্বীকার করে নিয়েছিলেন। 

তিনিই আমাকে এক মধ্যবয়সী পুরোহিত বাদল মিশ্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি স্থানীয় ‘বাবা মা’-র মন্দিরের – বাবা (ভগবান শিব) এবং মা (মা কালী)- তৎকালীন পূজারী। বাদল মিশ্রের বাবা ঐ একই মন্দিরের প্রাক্তন পূজারী বামদেব মিশ্রই তিন বছর আগে জ্যোৎস্নাকে ঐশ্বরিক বধূ হতে রাজি করিয়েছিলেন। 

বামদেব মিশ্র উড়িষ্যার ভদ্রক জেলার অন্তর্গত গদাধরপুর গ্রামের মানুষ। ১৯৯৭ সালে তার মৃত্যুর পর তার ছেলে (বাদল) মন্দিরের দায়িত্ব নেন। বাদল মিশ্র উপরোক্ত দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টের ঘটনাটি নিশ্চিত করেন। তিনি আরও নিশ্চিত করেন যে তিনি এই বিষয়ে তার বাবার বিরোধিতা করেছিলেন, যদিও আমি তার নিজের রাজ্যে (উড়িষ্যা) এই প্রথার বিষয়ে তার অবস্থান জিজ্ঞাসা করলে তিনি নিশ্চুপ থাকেন। আমরা মন্দিরের চাতালে বসে যখন কথা বলছিলাম তখন সেখানে কিছু গ্রামবাসী জড়ো হয়েছিল। তারা অবশ্য তাদের গ্রামে এই ঐশ্বরিক বিবাহের ঘটনায় তাদের গর্ব প্রকাশ করছিল। 

এরপর আমি শিকদার মশায়ের পরামর্শে মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা নগেন্দ্রনাথ দত্তের সাথে দেখা করতে যাই। পেশায় একজন চিকিৎসক এবং ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র একজন রাজনৈতিক সমর্থক ও হিন্দু ধর্মে দৃঢ় বিশ্বাসী শ্রীদত্ত (তখন বয়স ৭৩), যিনি বামদেব মিশ্রকে কয়েক বছর আগে মন্দির প্রতিষ্ঠার পরে পূজারী নিয়োগ করেছিলেন, তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তিনি জ্যোৎস্নাকে চিনতেন, কিন্তু ঐ বিয়ের আগে তিনি তার কাছ থেকে বা পুরোহিতের কাছ থেকে এ বিষয়ে কিছুই শুনতে পাননি এবং গ্রামে এরকম অনুষ্ঠানের জন্য তিনি অনুতপ্ত। এমনকি কয়েকশ গ্রামবাসী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তিনি আরও বলেন, এটা হতে পারে যে পুরোহিত এবং তার সহযোগীরা গ্রামে এমন ঘটনায় তাঁর সমর্থনের অভাব সম্পর্কে আগেভাগেই নিশ্চিত ছিলেন। “কিন্তু এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং এটি এই গ্রাম এবং আশেপাশের এলাকায় কোনও স্থায়ী প্রভাব তৈরি করতে পারে নি”,- আমি ঘটনার পরিণতি জানতে চাইলে শ্রীদত্ত এমনটাই বলেন। এর সঙ্গে পতিতাবৃত্তির কোনো সম্পর্ক নেই বলেও তিনি নিশ্চিত করেন। উপস্থিত সিকদার মহাশয়ও তার সাথে সহমত হন। 

কিন্তু জ্যোৎস্না কেন পুরোহিতের কথায় রাজি হল? উত্তরটা পেয়েছিলাম যখন ভাতজংলা গ্রামের একটি পাড়া নতুন কালীপুরে তার বাবার বাড়িতে তার সাথে দেখা হয়েছিল। বাদল মিশ্র আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে তার এবং তার বাবা-মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। 

প্রথম নজরেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে জ্যোৎস্না (যে নামের অর্থ চাঁদের আলো) দেখতে ভাল ছিল না এবং তার শারীরিক ত্রুটি ছিল। সে নাকিসুরে কথা বলে, অর্থাৎ সে নাক দিয়ে কথা বলে। আমি তার মা-বাবার সাথে আলোচনা থেকে বুঝেছি যে সে যখন বেশ ছোট ছিল, তারা তাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার শারীরিক ত্রুটির কারণে পাত্র জোটেনি। শেষ পর্যন্ত, তার অবিবাহিত থাকার অনিবার্যতা অনুমান করে তারা তাদের প্রচেষ্টা ছেড়ে দেন। 

আলোচনার সময় জানতে পারি, জ্যোৎস্না ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে গোপালের (শিশু ভগবান কৃষ্ণ) পূজা করত। যখন সে একজন পূর্ণ যুবতী হয়ে উঠল, আমার সামনে তার বক্তব্য অনুসারে, স্বপ্নে সে গোপালের বাঁশি বাজানোর শব্দ শুনত। এমনকি সে জেগে ওঠার সময় গোপালের পায়ের শব্দও শুনতে পেত। ‘‘কিন্তু তুমি কি এখন পর্যন্ত তার সাথে দেখা করেছ?’’, আমি জিজ্ঞেস করলে সে তৎক্ষণাৎ জবাব দেয়, ‘‘হ্যাঁ, পরশুই তো এসেছিল।’’ তার মনের এই অবস্থা অবশ্যই তার মানসিক বিচ্যুতিকে প্রমাণ করে যাকে ডাক্তারি ভাষায় সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) বলা যেতে পারে। 

আলোচনার মাধ্যমে আমি আরও জানতে পারি যে জ্যোৎস্না ওই মন্দিরে নিয়মিত যেত এবং সেখানে পুরোহিতের সাথে পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তারা ঘনিষ্ঠ হয়। প্রতারক পুরোহিত, সম্ভবত মন্দিরটিতে উড়িষ্যার ধরণের দেবদাসী প্রথা চালু করাতে চেয়েছিল। এতে আরও ভক্তদের আকৃষ্ট করা এবং তার আয় বৃদ্ধি তার গোপন উদ্দেশ্য ছিল বলে আমার অনুমান। পুরোহিত জ্যোৎস্নার মানসিকভাবে দুর্বল অবস্থার এবং হিন্দু সমাজে দীর্ঘদিন ধরে অবিবাহিত থাকার ফলে তার সামাজিক মর্যাদাহানির সুযোগ নিয়েছিল। 

শেষ পর্যন্ত প্রতারক পুরোহিতটি একটা গল্প বানিয়ে তাকে রাজি করিয়েছিল যে, ঈশ্বর নিজেই তাকে বিয়ে করতে চেয়েছে, যেমন দৈনিকটিতে রিপোর্ট করা হয়েছিল। 

যাইহোক, জ্যোৎস্না, আমার সাথে আলাপচারিতার সময় উল্লিখিত প্রতিবেদনের বিপরীতেই বলেছিল যে তার বিয়ের কয়েক মাস পরে সে বেশ হতাশা বোধ করেছিল; পরিবর্তে, সে তার আনন্দ প্রকাশ করে। “আমি এখন আমার স্বামী হিসাবে আমার গোপালকে নিয়ে বেশ খুশি যেমন আমি ছিলাম যখন বাবা (পুরোহিত) আমাকে প্রস্তাব করেছিলেন”।

তার বিয়ের অনুষ্ঠানের পরে, পুরোহিত দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছিল যে সে রহস্যময় পদক্ষেপের মাধ্যমে একদিন একটি সন্তানের মা হবে। যাইহোক, এমনটা এখনও পর্যন্ত ঘটেনি (অন্তত যখন আমি কয়েক বছর আগে জায়গাটি পরিদর্শন করি)।

জ্যোৎস্নার সাথে আমি যখন দেখা করি তখন মন্দিরের সাথে তার কোন নিয়মিত যোগাযোগ নেই এবং সে তার সময় কাটায় গৃহকর্মে নিজেকে নিযুক্ত রেখে এবং তার মা-বাবার বাসায় গোপাল মূর্তি পূজা করে।

প্রায় প্রতিবন্ধী ৮৫ বছর বয়সী নলিনীকান্ত দত্ত অবশ্য তার হতাশা লুকাতে পারেননি যখন আমি জিজ্ঞেস করলাম কোন পরিস্থিতিতে তিনি মূর্তির সাথে তার মেয়ের বিয়েতে সম্মতি দিয়েছেন। শ্রীদত্ত নিশ্চয়ই খুশি হতে পারতেন যদি তার বড় মেয়ে স্বপ্না দত্তের (বিয়ের পরে- রায়) মতো একজন মানুষের সাথে তার ছোট মেয়েরও বিয়ে হত। কিন্তু একজন সামান্য অঙ্কের পেনশন ধারক (প্রতি মাসে 1500 টাকা) শ্রীদত্ত তার দুর্বল আর্থিক পটভূমির কারণে পুরোহিতের বিরোধিতা করতে পারেননি। উপরন্তু, তিনি তেমন দৃঢ়চেতা চরিত্রের মানুষ বলেও এই প্রতিবেদকের মনে হয়নি। এছাড়া, তার নিকটবর্তী প্রতিবেশীরা যারা ঐশ্বরিক বিবাহ অনুষ্ঠান উপভোগ করার এমন সুযোগ হারাতে আনাগ্রহী ছিল তারা তাকে পুরোহিতের মতে মত দিতে প্রভাবিত করেছিল। এমনকি তার পাশের বাড়ির একজন প্রতিবেশী ক্ষিতিশ দাস নিজেই এই বিবাহ অনুষ্ঠান উদযাপনের দায়িত্ব নিয়েছিল। অনুষ্ঠানে আনুমানিক পাঁচ শতাধিক গ্রামবাসী উপস্থিত ছিল। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে তাদের মধ্যে মিষ্টি বিলি করা হয়েছিল। এসব শ্রীদত্তের বক্তব্য থেকে জানা গেছে। শ্রীদত্ত ও তার স্ত্রী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও প্রতিটি আয়োজনের জন্য বাধ্যতামূলক অর্থ প্রদান করা ছাড়া তাদের আর কোন ভূমিকা ছিল না। 

আমি জ্যোৎস্নার সাথে আলাপচারিতায় ব্যস্ত থাকাকালীন কয়েকজন প্রতিবেশী মহিলা আমাকে কৌতূহলবশত দেখতে আসে। তাদের মধ্যে একজন হল পূর্বোক্ত ক্ষিতিশ দাসের স্ত্রী ছায়া দাস, যে খোলাখুলি বলে, ‘‘আমরা ঐশ্বরিক বিবাহ সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি কিন্তু দেখিনি। আমরা নিজের চোখে এমন অনুষ্ঠান দেখতে পেরে এবং নিজের জায়গায় এমন পবিত্র অনুষ্ঠানের সাক্ষী হতে পেরে যথেষ্ট খুশি’’। সেখানে উপস্থিত অন্যান্য মহিলারা, যাদের বেশিরভাগই বিবাহিত, তাকে সমর্থন করে। শ্রীমতী দাসের যুবতী কন্যাও মহিলাদের মধ্যে ছিল। 

কিন্তু যখন আমি শ্রীমতী দাসকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আপনার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব যদি কোনো মূর্তির সাথে করা হয় তাহলে আপনি কি রাজি হবেন?’’, চটজলদি জবাব ছিল- “না”। ‘‘বাবার মৃত্যুর পর জ্যোৎস্নার ভবিষ্যৎ কী?’’- শ্রীমতী দাস অবশ্য এবার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ‘‘ভগবান ওর সমস্যার সমাধান করবে।’’ 

এই অভিযানে আমার শেষ দেখা হয়েছিল জ্যোৎস্নার ছোট বোন স্বপ্না রায়ের সাথে। শ্রীমতী রায়, স্থানীয় শক্তিনগর হাসপাতালের একজন নার্স। তিনি তার সন্তানদের সাথে নিয়ে পৈতৃক বাড়িতেই আলাদা থাকেন। তার বড় বোনের ঐশ্বরিক বিবাহ সম্পর্কে প্রশ্ন করায় বলেন: “সে তার যা পছন্দ তাই করেছে, আমার বলার কিছু নেই”, এবং এইভাবে তিনি আমাকে এড়িয়ে গেলেন।


দেবদাসী প্রথা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ, কিন্তু আমি একজন বাদল মিশ্র ছাড়া এই ঘটনা নিয়ে আওয়াজ তুলেছে এমন কাউকে পাইনি। বাদল মিশ্র আমাকে স্টেশনে ছাড়তে এসেছিল সন্ধ্যা নাগাদ। ট্রেনে ওঠার আগে আমি তাকে ১০ টাকার একটা নোট দিলাম। আমায় সাহায্য করার পারিশ্রমিক। সেদিন আমার কাছে বিশেষ কিছু ছিলনা। টাকার পরিমাণ খুব কম, কিন্তু এই অল্প প্রাপ্তিতেই তার মুখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল এবং তারপর সে আমাকে পরের বার তার মন্দিরে আবার আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেল। ট্রেনে আসার সময় আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে অন্য রাজ্য থেকে আসা এই খালি পায়ের, এলোমেলো খাটো পোশাক পরা ব্রাহ্মণটি কীভাবে তার নিজের পিতারই একটি খারাপ উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করার সাহস করেছিল, যখন অনেক গ্রামবাসীর সমর্থনে তা ঘটেছিল এবং স্থানীয় রাজনৈতিক দল ও প্রশাসন নীরব ছিল! ঘটনা ঘটার পর গত তিন বছরেও কেউ এগিয়ে আসেনি নির্যাতিতা নারীটির পুনর্বাসনে; যত ক্ষণ গ্রামে ছিলাম অন্তত এই বিষয়ে কিছুই শুনিনি। এত বছর পরে জ্যোৎস্না বেঁচে আছে কিনা জানি না। জানা নেই বেঁচে থাকলেও সে কেমন আছে?

ভারতীয় সমাজে বিংশ-একবিংশ শতকেও নানাপ্রকারের কুপ্রথা বিদ্যমান। শুধু দেবদাসী প্রথাই নয়, আছে কন্যাভ্রূণ হত্যা, শিশুকন্যা হত্যা, শিশুবিবাহ, সতীদাহ, ডাইনি সন্দেহে হত্যা, মায় শিশুবলি পর্যন্ত। পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে হত্যা-ও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। এসবই ভারতীয় আইন অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ঘটে চলেছে তবুও। অনেক কারণের মধ্যে সর্বাধিক উল্লখযোগ্য কারণটি হল, আইন প্রণয়নকারী ও আইন রক্ষকদের নক্কারজনক ভূমিকা। ১৯৮৭ সালে সতীপ্রথা’র নামে যেদিন রূপ কানোয়ার-কে জোর করে মৃত স্বামীর সাথে জলন্ত চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় সেদিন সেখানে যারা জড়ো হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল সরকারি ও বিরোধী দলের ঝান্ডাধারীরাও। না, তারা এই নৃশংশ হত্যাকান্ডের কেউ বিরোধিতা করেনি, ‘ধর্ম’রক্ষার পাহারাদারী করেছিল। সতীদাহ বে-আইনী, কিন্তু সেদিনের একজন হত্যাকারীরও এপর্যন্ত শাস্তি হয়নি, প্রমাণাভাবে সবাই বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে। রূপ কানোয়ারের ঘটনাটি স্বাধীন ভারতে ছিল ৩৮তম সতীদাহ-র ঘটনা। স্বাধীনতার পর থেকে কেবলমাত্র রাজস্থানেই অন্তত ৩০টি সতীদাহের ঘটনা ঘটেছে, যার কোনো প্রমাণ নেই। রূপ কানোয়ারের পরেও এমন ঘটনা কিন্তু থেমে থাকেনি এদেশে।


আমাদের দেশে দেবদাসী প্রথা আজও টিকে থাকার পিছনে আছে হীন কায়েমি স্বার্থ- গরিব মানুষ নিজেদের মেয়ে বেচে পরিবারের মুখে অন্ন যোগাবে আর ধনী ভূস্বামীরা ধর্ম ও ঐতিহ্য রক্ষার নামে নিরোগ কচি মেয়ের শরীর ভোগ করবে।এর সাথে জড়িত পুরোহিত-দালাল-ব্যবসায়ীদের স্বার্থ। আছে বড় বড় শহরের গণিকালয় গুলির মালিক-মালকিনদের স্বার্থ। এই মিলিত স্বার্থের বলি হয়ে চলেছে নিষ্পাপ শিশুকন্যারা।


আদিবাসী সমাজের মধ্যেও অনেক কুপ্রথা বর্তমান, যেমন ডাইনিহত্যা, জাদুকরী শিকার (witch hunting)-এসবের পিছনেও থাকে কায়েমি স্বার্থ।

আইন আছে তাতে কি? শিশুবিবাহ প্রতিরোধ আইন আছে (Prohibition of Child Marriage Act, 2006), তাতে কি শিশুবিবাহ বিলোপ হয়েছে? শিশুশ্রম প্রতিরোধ আইন আছে, তাতে শিশুশ্রম বিলোপ হয়েছে কি? কারণ আইন প্রণীত হলেও আইনরক্ষকদের তা প্রয়োগের সদিচ্ছার অভাব। সরকারী ভাষ্যে অবশ্য শিশুশ্রমিকের সংখ্যা পড়তির দিকে, যদিও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। জঙ্গীদমনে যে সরকারী তৎপরতা ইদানিং দেখা যাচ্ছে তার এক শতাংশও কি সামাজিক কুপ্রথা নিবারণের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে? আসলে জঙ্গীদমনের লক্ষ্য হল জল-জমিন-জঙ্গল-কে অবাধ লুন্ঠনের জন্য পুঁজিপতিদের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া, তাই সদিচ্ছার অভাব নেই। আর কুপ্রথায় জনগণ নিমজ্জিত থাকলে তারা অধিকার দবি করবেনা, তাই এক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাব। আইন? সে কেবলমাত্র মুখরক্ষার তাগিদে, বহির্বিশ্বকে বোকা বানাতে।


শুরুতেই বলেছি কেন এই নিবন্ধ রচনায় হাত দিয়েছিলাম। দেবদসী প্রথার মাহাত্ম প্রচার বা কেবলমাত্র তাদের জীবনগাথা তুলে ধরা আমার লক্ষ্য ছিলনা, বরং এই কুপ্রথার স্বরূপ উন্মোচন করাই ছিল আমার লক্ষ্য। নিবন্ধটি পাঠ করে যদি পাঠক এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন ও সমাজসংস্কারে আগুয়ান হন তবেই আমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করব।

জুন ২০২৩

চলুন এবার আমরা মূল নিবন্ধটিতে প্রবেশ করি।


Go to page 2




No comments:

Post a Comment

একাত্তরের জননী

  বর্তমানে বইটি মুদ্রিত নেই   একাত্তরের মা হয়েই আমৃত্যু কাটিয়েছেন।   প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধেও স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশন নেননি। একাত্তরের জননী...